বকুলকথা

বকুলকথা
-শম্পা দেবনাথ

 


সকাল থেকেই পরমার মেজাজ সপ্তমে।আমি আর মেয়ে রীতিমতো ভয়ে ভয়ে আছি।আজ রবিবার।গতকাল থেকে আমাদের বাড়ির কাজে পরমাকে সাহায্য করা মহিলাটি আসছে না।ওর নাম বকুল।এমনিতে সপ্তাহে একদিন, মাসে চারদিন ওর ছুটি থাকে।গতকাল বিকেলে খবর পাঠিয়েছে যে ,শরীর ভালো না।তাই মঙ্গলবারের আগে আসতে পারবে না।পাড়াটা মোটামুটি বকুল আর বকুলের দুই মেয়ের দখলে।বেশ মেজাজী।রানীগঞ্জের মত ছোট্ট শহরে ঘরের কাজে সাহায্য করার লোকের খুব অভাব।পরমা মানে আমার স্ত্রী, লোক ছাড়া এক মুহূর্ত চলতে পারে না।আজ বাইরে থেকে খাবার আনাব ভেবেছি।টাকার শ্রাদ্ধ হয় হোক্, কিন্তু গৃহ শান্তি বজায় থাকুক।নেহা মানে মেয়েকে বলেছি বেশী মায়ের কাছে না যেতে।বাড়ির পরিবেশ বেশ গম্ভীর।আমি কাল ভাবছি একটা সি.এল মেরে দেব।হাতে হাতে একটু সাহায্য করে দিলে বউ কিছুটা শান্ত থাকবে।সময়মতো তাহলে চা পেয়ে যাব আশাকরি।একটু লেখালেখির ঝোঁক আছে।তার জন্য মাঝেমধ্যে চায়ের জন্য পরমাকে যথেষ্ট তোয়াজ করে চলি।

বকুলের দুই মেয়ে।রঞ্জনা আর চন্দনা। রঞ্জনা বড়।বিয়ে হয়েছিল।একটা মেয়েও আছে।স্বামী তিনবছর পর অন্য মহিলার সাথে থাকতে শুরু করায় ,বিস্তর ঝগড়াঝাটি ,মারপিট করার পর রঞ্জনা নিজেই বাড়ি ছেড়ে চলে আসে। বকুল কখনও সখনও নাতনীকে নিয়ে কাজে আসে ।তিনবছরের মিষ্টি একটা ছোট্ট মেয়ে , ঝিমলি।পরমা কেন জানি ভীষণ বিরক্ত হয়।জিজ্ঞাসা করেছিলাম একদিন।বলল, ” ও এলে বকুল কাজে ফাঁকি দেয় বড্ড। তার ওপর নেহাকে খেতে দিলে তাকিয়ে থাকে।ভালো লাগে না এসব আমার “।
আমি অবাক হয়ে বলি ,” তা ঐটুকু একটা বাচ্চা ,ওকেও তো দিতে পারো।কি হয় দিলে ?”
” দি তো।অন্য বাড়ি বাইরে বসিয়ে রাখে দেখ গিয়ে।বকুল ইচ্ছে করে খাওয়ার সময় নিয়ে আসে”।
পরমার এমন ছোট ভাবনায় আমার কষ্ট হয়।
অথচ বিয়ের পর দেখেছি ছোটখাটো কারণে ওর চোখে জল আসত।আমাদের বাড়িতে একটা পোষা বেড়াল ছিল, মিনি।বয়স হয়েছিল।পরমা প্রথমে ওটাকে পছন্দ করত না।কিন্তু মিনির সাথে ভাব হয়ে যায়।মিনি একবার অসুস্থ হলে পরমা দিন রাত ভুলে ওর সেবা করেছে।পরে যখন মিনি মারা যায় ,পরমা দুদিন খায়নি।কি কান্না তার। এ পরমাকে আমি আগের সাথে ঠিক মেলাতে পারি না।ওর ঐ নরম মনটা কোথায় হারিয়ে গেল ,ভাবি।

এইভাবেই চলছিল বেশ।আমি ব্যস্ত আমার কাজ আর লেখালেখি নিয়ে।পরমা ব্যস্ত তার সংসারের খুঁটিনাটি নিয়ে।যদিও আমি সাধারণতঃ কোনও ব্যাপারে নাক গলাই না। পরমার হাতে টাকা দিয়ে হাত তুলে দি।পরমাই সব করে।তাই খরচ নিয়ে কথা বলা আমার সাজে না।এরমধ্যে একদিন দেখি বকুলের জায়গায় রঞ্জনা এসে কাজ করছে। পরপর তিন-চারদিন হয়ে গেল।কৌতূহলবশতঃ স্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করাতে বলল,বকুল অসুস্থ।তাই রঞ্জনাই সামলাচ্ছে।যাক, আমার টেনশন কমল।বকুল এটা বুদ্ধিমতীর মতো কাজ করেছে মেয়েকে পাঠিয়ে।
রঞ্জনা ধীরে ধীরে পরমার খুব নির্ভরযোগ্য হয়ে উঠল।কিছু অতিরিক্ত কাজও করে দিতে লাগল।আমাকে সকালের দিকে চাও ও করে দিত।পরমা দেখলাম রঞ্জনার প্রশংসায় পঞ্চমুখ।এরমধ্যে একদিন আমায় বলল,এরপর বকুলকে ছাড়িয়ে রঞ্জনাকেই রাখবে।আমি মৃদু আপত্তি করেছিলাম।ধোপে টিকল না।আমি যে সংসারের জন্য কতটা অনভিজ্ঞ সেটা পরমা যথারীতি মনে করিয়ে দিল।অগত্যা চুপ করে গেলাম।

একদিন বাজার থেকে ফিরে দেখি বকুল আর পরমার খুব ঝগড়া হচ্ছে।জানতাম হবে।বকুল তার অধিকার ছাড়বে না।
“তুমি জাননা বৌদি ,মেয়েটা একদম বাজে হয়ে গেছে।ঘরে একপয়সাও দেয় না।নিজের মেয়েটাকে দেখেও না।ঐ একরত্তি বাচ্চাটা মা-মা করে হেদিয়ে মরে।ডাইনিটা ঘুরেও তাকায় না।আমার হয়েছে যত জ্বালা।তুমি ওকে রেখোনা বৌদি।কাল থেকে আমিই আসব।”
“তোমার বয়স হচ্ছে বকুল।শরীর ভালো যায় না।প্রায়ই কামাই কর।রঞ্জনা তো বলে ,তুমিই ওকে দেখতে পারো না।তোমার যত টান ছোট মেয়ের প্রতি।তাছাড়া ও কামাই করে না।টুকটাক এক্সট্রা কাজ করে দেয়।তুমি তো কিছু বললেই ঝাঁঝিয়ে ওঠ।আমাকে তো আমার ফায়দাও দেখতে হবে?” পরমাও ছাড়ার পাত্রী নয়।
বুঝলাম,ছুটির দিনে যে নতুন একটা লেখা শুরু করেছিলাম ,তাতে এখন এদের প্রেমালাপে মনসংযোগ করা যাবে না।পাঞ্জাবীটা গলিয়ে হারুর চায়ের দোকানের উদ্দেশ্যে হাঁটা দিলাম।

পরমাই শেষ পর্যন্ত জিতে গেল।রঞ্জনাই বহাল হল।যদিও রঞ্জনার অতিরিক্ত ভালো মানুষী কেন যেন আমার ভালো লাগত না।একথা একবার পরমাকে বলেছিলাম।
“তোমার ভালো জিনিস কবে ভালো লেগেছে।তাহলে তো আমার সাথে ভালো ব্যবহার করতে।আমার কোনও কিছু ভালো দেখেছ কোনোদিন ?” পরমা সহজ অকাট্য যুক্তি দিল।
বলে বুঝলাম মৌচাকে ঢিল মেরে বিনা প্রোটেকশনে দাঁড়িয়ে রয়েছি।কবে যে আমার বুদ্ধি হবে সেই ভেবে পরবর্তী আক্রমণের জন্য প্রস্তুত থাকলাম।

শীত শেষ হয়ে বসন্ত ধীরে ধীরে কাছে আসছে।নতুন পাতা,নতুন কুঁড়িতে সামনের কৃষ্ণচূড়া রঙ ছড়াচ্ছে।এই সময়টা সত্যিই খুব সুন্দর।আমার একটা বই এবারের স্থানীয় বইমেলায় বেরিয়েছে।সেই নিয়ে খুব ব্যস্ত থাকায় সংসারে বিশেষ মন দিতে পারিনি। শনিবার অফিস ছুটি থাকে।দুপুর বেলা।পরমা কোথাও বেরিয়েছে।ইজিচেয়ারে গা এলিয়ে পূর্নেন্দু পত্রীর পকেট বইয়ের সংকলন নিয়ে নাড়াচাড়া করছি এমন সময় পরমা ছুটতে ছুটতে এসে বলল ,”চল হাসপাতালে যাব”।
“কোথায় ,কেন, কার কি হল ‘? আমি লাফ দিয়ে উঠি।
“বকুলের অবস্থা খুব খারাপ। চল যেতে যেতে বলব। “।পরমা গুছিয়ে নিতে নিতে বলল।

পথে যেতে যেতে সংক্ষেপে যা শুনলাম তা হল- বকুল কদিন থেকেই অসুস্থ।রঞ্জনা ,বকুলকে হাসপাতালে ভর্তি করবে বলে পরমার কাছ থেকে দশহাজার টাকা নেয়।পরমাও দিয়ে দেয়।পরশু থেকে রঞ্জনা আসছে না ।কোনও খবরও পাঠায় নি।গতকাল পরমা ,রঞ্জনা যে যে বাড়িতে কাজ করে সেই সেই বাড়িতে খোঁজ নিতে গিয়ে দেখে ,রঞ্জনা ওদের থেকেও তিন -চার হাজার করে টাকা ধার নিয়েছে। আজ সকালে বকুলের ছোট বোন চন্দনা মুখার্জীদের বাড়িতে গিয়ে কান্নাকাটি করে বলে গেছে ,রঞ্জনা পরশু ঘর থেকে কোথায় চলে গেছে। ঘরে দু -তিনটে সোনার কানের দুল,একটা গলার চেন সব উধাও।কোনও টাকাপয়সাও নেই।মেয়েটা মা -মা করে কাঁদছে।বকুল সত্যিই অসুস্থ।কাল রাতে বাড়াবাড়ি হওয়ায় ওকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।একা চন্দনা ঐটুকু বাচ্চা মেয়েটাকে নিয়ে জলে পড়েছে।
আমি শুনলাম সব।জানতাম ,কিছু একটা হবে।রঞ্জনার হাবভাব কোনদিনই আমার পছন্দ ছিল না।এখন এসব প্রসঙ্গ তুলে লাভ নেই।আগে হাসপাতালে পৌঁছনো দরকার।

বৈশাখের শুরুতেই এত গরম পড়ে গেল যে দুপুরে ঘর থেকে বেরোনো প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ল।এমনিতে রানীগঞ্জে গরম একটু বেশীই পড়ে।আজ অফিস ছুটি থাকায় ভেবেছিলাম একটু আসানসোল যাব ব্যক্তিগত কাজে।গরমে আর ভালো লাগল না।কুঁড়েমি পেয়ে বসল।চিরসঙ্গী বই নিয়ে বসলাম।মানুষ চেনা যে কত বাকি তা ফ্রয়েডের ‘ইন্টারপ্রিটেশন অফ ড্রিম’ ঘাটাঘাটি করতে করতে ভাবছিলাম।যে পরমাকে আমি চিনতাম তার এই রূপ আমি কি কল্পনা করেছিলাম কখনও!
সেদিন বকুলকে হাসপাতালে দেখে পরমা হাউহাউ করে কেঁদে ফেলেছিল।চন্দনা ,ঝিমলিকে নিয়ে উদভ্রান্ত।কি করবে ভেবে পাচ্ছে না।বকুলের গলব্লাডারে স্টোন ধরা পড়ল।পরমা নিজে রোজ গিয়ে ডাক্তারদের সাথে কথা বলে অপারেশনের দায়িত্ব নেয়।ঝিমলিকে ও চন্দনাকে নিজের ঘরে রাখে।চন্দনা এখান থেকেই কাজে যেত।নেহার স্কুলে গরমের ছুটি পড়াতে ঝিমলিকে রাখতে অসুবিধা হয় নি।পরমা নিজের হাতে ঝিমলিকে খাইয়ে দিত। বকুল হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাবার পর চন্দনা ওদের ঘরে ফিরে গিয়েছিল।ঝিমলিকে আরও অনেক দিন পরমা নিজের কাছে রেখেছিল। বকুল পুরোপুরি সুস্থ হয়ে এখন শুধু আমাদের বাড়িতেই কাজ করে।তবে ভারী কাজগুলো চন্দনা এসে করে দেয়। ঝিমলিও সারাদিন এখানে থাকে।বিকেলে বকুল আর ঝিমলি বাড়ি ফিরে যায়।

আমি মাঝেমধ্যেই অবাক হয়ে পরমাকে দেখি।ওর মুখটা অদ্ভুত পবিত্র লাগে।দেবীর মত মনে হয়।হাঁ করে তাকিয়ে থাকি।পরমা চা দিতে এসে হালকা ধাক্কা দিয়ে বলে ,”মশাই মেয়ে বড় হয়েছে , তাকানোটা একটু ঠিক কর।দিন দিন খুব অসভ্য হয়ে যাচ্ছ তুমি”।
এমন অসভ্য আমি সারাজীবন থাকতে চাই ,মনে মনে বলি আমি

Loading

Leave A Comment